- দেবক বন্দ্যোপাধ্যায়
১
একটা অপ্রকাশিত গল্পের নেপথ্যের কাহিনি দিয়ে শুরু করছি। কমবেশি চার দশক আগের কথা। কলকাতা থেকে সরকারি চাকুরে ও ব্যবসায়ীদের একটি দল বেড়াতে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে। আজিমগঞ্জ সেই অর্থে বেড়াবার জায়গা নয়। আসলে বাঙালির এই দলটার সকলেই ভারত স্কাউটস অ্যান্ড গাইডসের সঙ্গে যুক্ত। আর আজিমগঞ্জে আছে একটা স্কাউট ডেন। তারা সেখানেই উঠেছে। সেখানেই চড়ুইভাতি। সেখানেই বন ফায়ার। ওরই মধ্যে একদিন শীতের দুপুরে মাংস ভাত সাঁটিয়ে শহুরে বাবু বিবিদের শরীর আর চলছে না। এতগুলো এঁটো বাসন মাজবে কে? ওদের মধ্যে সপ্রতিভ একজন একটা উপায় বার করলেন। মাঠের ধারে বসে বসে এতক্ষণ যে ছেলেমেয়েগুলো ওদের খাওয়া দেখছিল, বেঁচে যাওয়া খাবার ওদের খেতে দিয়ে বললেন, খেয়ে নিয়ে বাসনপত্র সব মেজে দিবি। যাক! একটা উপায় পাওয়া গেল ভেবে সবাই ভাতঘুমে ঢলে পড়ল। সন্ধের মুখে ঘুম ভাঙতে মাথায় বজ্রপাত। ওই ছেলেমেয়ে গুলো খাবার তো খেয়েছে কিন্তু এঁটো বাসন যেমন ছিল তেমন পড়ে আছে। বাবুদের মধ্যে একজন চিৎকার করে উঠল, বলেছিলাম, আমি বলেছিলাম, এরা বেইমানের জাত! খাবার খেয়েছে কিন্তু বাসনে হাত লাগায়নি। এসো, এই ঠাণ্ডায় মাজো বাসন...
এই ঘটনার উল্লেখ করে চার দশক আগে একটা গল্প লেখা হয়েছিল, যা প্রকাশ করা হয়নি। ওই বাসন না মাজা ছেলেমেয়েগুলো এখন বড় হয়েছে। পঞ্চাশ ষাট পেরিয়েছে। সে দিনের ওই বাবু বিবিরা অনেকেই আর বেঁচে নেই, সেদিন যে ছেলেমেয়েগুলো বুঝতে পারেনি, কেন তাদের বেইণানের জাত বলা হল। এতদিন পর তারা হয়তো বুঝেছে! কিংবা ঠিক স্পষ্ট করে আজও বোঝেনি।
রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ অথবা চারু মজুমদারের মাটিতে এক শ্রেণির বাঙালির পরধর্ম বিদ্বেষ নতুন নয়। আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এই বিষ ফেটে বেরোবার জায়গা পেয়েছে ঠিকই তবে এই গরল নতুন না। সম্প্রতি সমাজ মাধ্যমে একটি পংক্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমরা সেই দেশে থাকতাম, যেখানে গফুর মিঞার গরুর নাম ছিল মহেশ। শরৎচন্দ্রের বিখ্যাত গল্প মহেশের কথাই বলা হয়েছে এখানে। যদিও একথা বলা বাহুল্য। শরৎবাবুর এই গল্পে উচ্চবর্ণ হিন্দুরা কী নিদারুণ অত্যাচার গফুরকে করেছিল, কথা সাহিত্যিক চোখের জলে তার বর্ণনা করে গেছেন। যদিও গফুর দাগী হয়ে ছিল গো-হত্যার 'পাপে!'
গত শতাব্দীর শরৎবাবুই হোন কিংবা চার দশক আগের এই অপ্রত্যাশিত গল্পের কথক, তাঁদের লেখায় উঠে এসেছে একটি নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষের প্রতি অসম্মান। অসম্মানের যে বোধ থেকে কোনও বিজেপি নেতা শহিদ ঝন্টু আলি শেখের বাড়ি যান না। পহেলগাম কাণ্ডে আদিল তাঁর প্রাপ্য সম্মান পান না আর অপারেশন সিঁদুরে নেতৃত্ব দেওয়া শ্রীমতি কুরেশিকে জঙ্গিদের বোন মনে করেন এক মন্ত্রী! তার বক্তব্যে যে প্রকাশ পায় তা হল, তিনি সব মুসলমানকেই জঙ্গি মনে করেন।
২
মুর্শিদাবাদের তৃণমূল নেতা, ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর।
রাজ্যের বিতর্কিত রাজনৈতিক চরিত্রগুলির মধ্যে একজন। যাঁর নামে অভিযোগ তিনি নাকি হিন্দুদের কেটে ভাগীরথীতে ভাসিয়ে দেবেন বলেছিলেন! এ হেন হুমায়ুনের সঙ্গে এক চাঁদি ফাটা দুপুরে দেখা হল মধ্য কলকাতার একটি রেস্তোরাঁয়। মশলা কোলায় চুমুক দিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নাকি হিন্দুদের কেটে ভাগীরথীতে ভাসাবার নিদান দিয়েছিলেন! আপনি তো সাংঘাতিক হিন্দু বিদ্বেষী!
হুমায়ুন এক চোট হেসে বললেন, ‘কংগ্রেসী পরিবারে আমার জন্ম। মানসিকতা তৈরি হয়েছে কংগ্রেসের দর্শনে। আমি ধর্মপ্রাণ। আমার ধর্ম আমাকে পরধর্মে বিদ্বেষ করতে শেখায় না।’
পাল্টা প্রশ্ন, তাহলে এমন গা গরম করা বক্তৃতার মানে?
‘আমার সভার আগের দিন ওখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ।’ বললেন হুমায়ুন। ‘উনি যা বলেছিলেন, তাঁর কথার প্রতিবাদে আমি ওই কথা বলেছিলাম।’
‘তাহলে তো বলেছেন!’
মাঝখানে থামিয়ে ছিটকে গেল প্রশ্ন।
‘আমি সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে বলেছি। কোনও সম্প্রদায়কে তো বলিনি। বিজেপি আর হিন্দু এক হল নাকি! ছোটবেলা থেকে হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি বড় হলাম। ওরা এসে এখন পরিবেশ বিষাক্ত করছে।’
ইচ্ছে করে হুমায়ুনকে একটু উস্কে দেবার জন্য বললাম, অপারেশন সিঁদুর, আপনার মতে, এই নামকরণ কি উচিত হয়েছে? আদিলের স্ত্রী, ঝন্টু আলি শেখের স্ত্রী, এঁরাও তো স্বামী হারালেন। তাঁদের ধর্মে তো সিঁদুর নেই। তাহলে তাঁদের ইমোশান এই নামকরণে ঠাঁই পেল কই?
হুমায়ুন শান্তই রইলেন। বললেন, ‘এইসব কথা বলার এটা সময় নয়। এতজন হিন্দু মহিলা সিঁদুর হারিয়েছেন। নামকরণ ঠিকই হয়েছে।’ প্রশ্ন করলাম, এইসব কথা বলার এটা সময় নয় বলছেন! ভালো কথা। তাহলে বিজেপির মন্ত্রী কুরেশিকে জঙ্গিদের বোন বলছেন, তাহলে এটা নিয়েও এখন কিছু বলা যাবে না?
একটু চুপ করে থেকে হুমায়ুন বললেন, ‘বিজেপির কাছে অনুরোধ, মুসলমানদের ন্যূনতম সম্মানটুকু করুন!’
...
সেই ছেলেমেয়েগুলো একটু সম্মান পেলে হয়তো বাসন না মেজে পালাতো না...
গফুর একটু সম্মান পেলে হয়তো মহেশ মরত না...
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
(দেবক বন্দ্যোপাধ্যায় ২৯ বছর সাংবাদিকতা করছেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় পেশাগত হাতেখড়ি, তার পরে ‘নিউজ টাইম’, ‘লুক ইস্ট’, ‘নর্থ ইস্ট টেলিভিশন’-সহ আরও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন তিনি। বেশ কিছু সময় সামলেছেন সম্পাদকের দায়িত্বও। বর্তমানে সাংবাদিকতার পাশাপাশি কয়েকটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে রাজনীতির বিশ্লেষক।)