সাক্ষীরা ভিন্ন কথা বললেই যে ধর্ষণে দোষী সাব্যস্তকে মুক্তি দিতে হবে, এটা হতে পারে না। একটি ধর্ষণের মামলার শুনানি চলাকালীন এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অজয়কুমার মুখোপাধ্য়ায়। গত ১৩ মে ওই মামলার শুনানিতে আদালতের অবস্থান স্পষ্ট করেন বিচারপতি।
জানা গিয়েছে, ২০২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মালদা জেলায় ধর্ষণের একটি ঘটনা ঘটে। এফআইআর অনুসারে - সেদিন নিগৃহীতা তাঁর বাড়ি থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে মাঠে গিয়েছিলেন। সেখানেই এক যুবক তাঁর মুখোমুখি হয় এবং তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
তরুণী সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ওই যুবক প্রথমে তাঁকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। তারপর তাঁকে মাটির উপর দিয়েই টানতে টানতে নিয়ে যায় এবং তাঁকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনার পর বাড়ি ফেরার পথে তরুণীর সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের দেখা হয়, তিনি তাঁকে সব কথা বলেন। এবং সেদিনই তরুণীর ভাই স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
২০২২ সালে ওই যুবককে দোষী সাব্যস্ত করে নিম্ন আদালত এবং তাকে হাজতে পাঠায়। ইতিমধ্যেই ওই যুবক চারবছর জেল খেটেছে এবং লাগাতার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে এসেছে। তার আইনজীবীর বক্তব্য, এই ঘটনায় সাক্ষীদের বয়ান নিগৃহীতার বয়ানের সঙ্গে মেলেনি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁরা অন্য কথা বলেছেন। মূলত, এই যুক্তির উপর ভিত্তি করেই কলকাতা হাইকোর্টে দোষীর মুক্তির দাবি জানান তাঁর আইনজীবী।
কিন্তু আদালতের পর্যবেক্ষণ হল - সাক্ষীরা ভিন্ন কথা বলেছেন বলেই ওই দোষী যুবককে মুক্তি দেওয়া যায় না। কারণ, নিগৃহীতা তাঁর বয়ানে অটল রয়েছেন। এবং তাঁর বয়ানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল অফিসারের পেশ করা রিপোর্ট মিলে গিয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই তরুণীর উপর যে জোরজবরদস্তি করা হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। এবং এক্ষেত্রে সঙ্গমের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যৌন অত্য়াচারের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
নিগৃহীতার বয়ান এবং এই মেডিক্যাল রিপোর্টে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আদালত আরও একটি বিষয়ের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে। তা হল সময়সীমা। দোষীর আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, সাক্ষীরা ভিন্ন কথা বলেছেন জিজ্ঞাসাবাদের সময়। কিন্তু, আদালতের পর্যবেক্ষণ হল - ওই সাক্ষীদের একটা লম্বা সময় পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
বিচারপতি এই প্রসঙ্গে বলেন, যেহেতু নিগৃহীতা লাগাতার একই কথা বলেছেন এবং নিজের বক্তব্যে অটল থেকেছেন, তাই এখানে তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে আলাদা করে সমর্থন জরুরি নয়। আর, এই সমস্ত ছোটখাটো বৈপরীত্যের জন্য কখনই নিগৃহীতার আইনজীবীর পেশ করা তথ্যপ্রমাণ উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিচারপতি আরও বলেন, মূল অভিযোগ ছিল, নিগৃহীতাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয় হয়েছিল এবং তারপর আবেদনকারী তাঁকে বিবস্ত্র করেছিলেন এবং তাঁকে ধর্ষণ করেছিলেন। এই মূল অভিযোগের স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পেশ করেছেন নিগৃহীতার আইনজীবী।
বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, এই প্রেক্ষাপটে দোষীর আইনজীবী কেবলমাত্র সাক্ষীদের ভিন্ন বয়ানের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু, তাঁরা লম্বা সময় পর জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটাও দেখতে হবে। এটা নিম্ন আদালতের শুনানিতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই যদি এই বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র সাক্ষীদের বয়ানের ভিত্তিতে দোষীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা বিচারের অপমৃত্যু হবে।